কে এম মিঠু, গোপালপুর :
শতাব্দী পেরিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাওয়া দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠটি ব্রিটিশ রাজত্বে যখন পূর্ববাংলা অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় ভরপুর ছিল সেই দুর্দিনে প্রচন্ড শিক্ষানুরাগী, মানবতাবাদী ও ন্যায় বিচারক জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯০০ সালে তাঁর বিমাতা মায়ের নামে প্রায় ২০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীন এ ইংলিশ মিডিয়াম হাইস্কুলটি শুরু থেকেই মানবিক গুণসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানবসম্পদ তৈরি করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির অনেক কৃতী শিক্ষার্থী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, চিকিত্সক, বুদ্ধিজীবী ও সুপ্রতিষ্ঠিত দেশবরেণ্য আলোকিত মানুষ হয়ে নানা পর্যায়ে সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে প্রাচীনতম এ প্রতিষ্ঠানের গৌরব অক্ষুণ্ন রাখছে।
ব্যক্তিগত চরিত্রে জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী বহু গুনাবলীর অধিকারী ছিলেন। প্রজাসাধারনের সুবিধার্থে তিনি রাস্তার মোড়ে মোড়ে কুপ র্নিমাণ এবং বহুসংখ্যক পুকুর খনন করেন। তিনি অত্যন্ত সৌখিন এবং সুন্দরের পুজারী ছিলেন। হেমনগরের প্রাকৃতিক নৈস্বর্গিক দৃশ্যের মধ্যে নির্মিত তার অপূর্ব কারুকার্যময় বাসভবন আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। হেমচন্দ্র চৌধুরী অত্যন্ত ধর্মভীরু হলেও ইসলামের প্রতি যথেষ্ঠে উদার ছিলেন।
হেমচন্দ্র চৌধুরীর পিতা কালিচন্দ্র চৌধুরী তদানিন্তন ময়মনসিংহ জেলার মধুপুর থানার অর্ন্তগত আম্বারিয়া এস্টেটের জমিদার ছিলেন। জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন কালিচন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র পুত্র সন্তান। তাছাড়াও কালিচন্দ্র চৌধুরীর তিন কন্যাও ছিল। আর জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী চার পুত্র ও চার কন্যার জনক ছিলেন।
হেমচন্দ্র চৌধুরী আম্বারিয়া হতে যমুনা নদীর পূর্বতীরে গোপালপুর থানার সুবর্ণখালী নামক গ্রামে দ্বিতীয় বাড়ী নির্মাণ করেন এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। সুবর্ণখালীতে দীর্ঘদিন বসবাস করার পর যমুনার নদীভাঙ্গনের কবলে পড়লে তিনি সেখান থেকে ১৮৯০ সালে বর্তমান অবস্থান শিমলাপাড়া গ্রামে নতুন বাড়ী নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন। আর তাঁর নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ করা হয় হেমনগর।
ময়মনসিংহ আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠায় দশজন দাতার তালিকায় জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর নাম চার নম্বরে লিপিবদ্ধ আছে। তিঁনি চট্রগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির, টাঙ্গাইল ফৌজদারী উকিলবার প্রতিষ্ঠা করাসহ গোপালপুর সূতী ভি এম পাইলট হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমি ও অর্থ দান করেন। পিংনা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায়ও তার সিংহ ভাগ অবদান রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ময়মনসিংহ ডিস্ট্রিক গেজিটিয়ারে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ১৯২৩ সালে টাঙ্গাইল মহকুমায় সবচেয়ে বেশি ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা (টাঙ্গাইল শহর বাদে) ছিল গোপালপুর থানায়। ওই সময়ে এ থানায় ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা ছিল ৬৯৮ জন। হেমনগর প্রাইমারি ও হাইস্কুল স্থাপনের ফলে হেমনগরের আশপাশের কাহেতা, নারুচি, শাখারিয়া, অর্জুনা, শিমলাপাড়া, নলিন, ভোলারপাড়া ও বেলুয়া গ্রাম গোপালপুর উপজেলায় শিক্ষাদীক্ষায় প্রথম জনপদ হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। এখনো এসব গ্রামে বহু মুসলিম বনেদী পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়।
তথ্যসূত্র : হেমনগর জমিদারের সাতকাহন